।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
ডিভোর্স
-অমিত কুমার জানা
প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল বিভাসদার চায়ের দোকানে গিয়ে লাল চায়ে এক চুমুক দিয়েছি,এমন সময় বিভাসদার মোবাইলটা বেজে উঠলো। এক দু মিনিট কথোপকথন হওয়ার পর বিভাসদা আমাকে বললো, “বুঝলি ভাই, একটা সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি। আমার পাড়ার একটা ছেলেকে ডিভোর্স হওয়া থেকে বাঁচিয়েছি।” আমি কৌতূহলী হয়ে মজার ছলে বললাম,”তুমি কবে থেকে আবার সমাজ সেবা করছো গো? দোকান চালানোর সাথে সাথে আজকাল এইসব হিতকর কাজও করছো,বেশ ভালো কথা।”
বিভাসদা বললো, “আসলে আমাদের পাড়ার একটা ছেলে জিতেন, পাঁচ বছরের বিবাহিত। তিনদিন আগে স্ত্রী (কেকা)-র সাথে ওর প্রচণ্ড ঝগড়া হয় এবং ওর স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যায়। শুধু তাই নয়,জিতেন এবং কেকা উভয়েই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। জিতেনের শ্বশুর, শাশুড়ী এবং সম্বন্ধী সবাই ওর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সম্বন্ধী তো জিতেনের নামে বধূ নির্যাতনের মামলা করবে বলে হুমকিও দেয়। এদিকে জিতেন ও তার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে অনড়। গত পরশু রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পথে গ্ৰামের ক্লাবে ঢুকেছিলাম। ক্লাবের ভেতরে কয়েকটা ছেলে ক্রাম খেলছিল।
ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম ক্লাবের উঠোনের এককোণে জিতেন বসে বসে সুরা পান করছে। এ অবস্থাতেও তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। যে ছেলেটাকে আগে কখনো সুরাপান করতে দেখিনি,তাকে এমতাবস্থায় দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে কি হয়েছে। “
জিতেন এমনিতে মিতভাষী, কিছুক্ষণ পর ও বললো যে ওর পত্নীর সাথে ভীষণ ঝগড়া হয়েছে এবং রাগান্বিত হয়ে ও ওর উপর হাতও উঠিয়েছে। সেই থেকে কেকা বাপের বাড়ি পালিয়ে গেছে।
বিভাসদা ওকে ঝেড়ে কাশতে বললো। জিতেন বলতে শুরু করলো, ” কেকার সাথে আমার বিয়ের কিছুদিন পর আমি কলকাতায় চলে আসি। কলকাতায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতাম। কিন্তু কেকা গ্ৰামের বাড়িতে একা একা ভীষণ বোর হয়ে যেত। তাই কিছুদিন পর ওকেও কলকাতায় নিয়ে চলে আসি। এখানে আমরা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। পাশের বাড়ির এক বৌদি খাবার রান্না করে খাবার পাঠিয়ে দিতেন। আমরা দুজনেই উনার রান্নার প্রশংসা না করে পারতাম না।
সকল দশটায় খাওয়া দাওয়া করে আমি চলে যেতাম ডিউটিতে,তারপর ফিরে আসতাম সন্ধেবেলায়। ও সারাদিন একা একাই থাকতো। এতেও ও বোরিং ফিল করতো। কেকা মাধ্যমিক পাশ। তাই ওকে বললাম ও যদি আর পড়াশোনা করতে চায় তবে ওকে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি করবো। ও রাজী হয়ে গেল। সেইমতো ওকে আবার নিয়ে এলাম গ্ৰামের বাড়িতে। পাশের গ্ৰামের একটা হাইস্কুলে ওকে ইলেভেনে ভর্তি করলাম। তারপর আমি কর্মসূত্রে কলকাতায় চলে এলাম। গ্ৰামের বাড়িতে ও আমার বাবা মায়ের সাথে থাকতো। এইভাবে মাসখানেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওর সম্বন্ধে যা শুনতে শুরু করলাম তাতে আমি বেশ টেনশনে পড়ে গেলাম। শুধু তাই নয় কেকার উপর আমার মনে ক্ষোভের আগুন জমা হতে লাগলো। আমি যতটা সম্ভব দ্রুত গ্ৰামের বাড়িতে ফিরে এলাম। বেশ কয়েকজন বন্ধুর মুখে শুনলাম যে কেকা ক্লাসের এক বন্ধুর সাথে পার্কে যায়। এককথায় কেকা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি ওকে বোঝালাম যে বিয়ের পর এসব করা ভদ্র মেয়েদের মানায় না।আমি এসব সহ্য করবো না। “
জিতেনের এসব কথা কেকা মোটেই সহ্য করলো না। শুধু তাই নয় সে বলতে শুরু করলো, “কলকাতায় যে বৌদি তোমাকে খাবার পাঠাতেন তুমি উনার যে সব অশ্লীল চ্যাট করতে তা আমি জানি। তুমি যদি অবৈধভাবে ঐ বৌদির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারো,তবে আমি কেন পারি না। আমি তোমার ফোনে হোয়াটস্ এপ ম্যাসেজ চেক করে এসব জানতে পারি।”
প্রত্যুত্তরে জিতেন বললো, “ও তুমি তাহলে গোয়েন্দাগিরি করতে আমার সাথে কলকাতায় গিয়েছিলে? ঐ বৌদির সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই,জাস্ট টাইমপাস ছাড়া কিছু নয়।”
এইসব কথোপকথন হতে হতে এই যুবদম্পতির মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলো। একে অপরকে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো। জিতেন
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কেকাকে সজোরে এক চড় লাগিয়ে দিল। অতঃপর জিতেন বললো,”আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়েই ছাড়বো।”
কেকা উত্তেজিত হয়ে বললো, “তোমার সাথে কে থাকবে? আমিও ডিভোর্স চাইছি এখনই।”
এই বলে কেকা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। এরপর বিভাসদা বললো, “পরদিন ক্লাবে জিতেনকে পরামর্শ দিলাম যে ডিভোর্স হতে বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু তোদের দুজনের ভবিষ্যৎটা কি হবে? তোর মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে? এক কাজ কর, তুই এখনই কেকাকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর যে ওকে নিয়ে আসতে গেলে ও ফিরে আসবে কিনা?”
জিতেন তখনই কেকাকে ফোন করলো এবং কেকাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফিরে আসতে রাজী হয়ে গেল।
বিভাসদা জিতেনকে বুঝিয়ে বললো, “তুই বেশ কিছু ফল মূল,মিষ্টি নিয়ে বিকেলের দিকে শ্বশুরবাড়ি চলে যা। আর হ্যাঁ, ওখানে গিয়ে রাতে কেকার সাথে একসাথে সময় কাটিয়ে সকালে ফিরে আসবি।”
জিতেন তাই করলো। যদিও জিতেনের সম্বন্ধী তা মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু সকাল হতে না হতেই জিতেন এবং কেকা হাসিমুখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কেকার বাপের বাড়ির লোকজন তো একেবারে অবাক।
সকালে বাড়িতে পৌঁছে জিতেই প্রথমেই বিভাসদাকে ফোন করে বলে, ” কি ভাষায় যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো বুঝে উঠতে পারছি না। তুমি আমার বিরাট একটা সমস্যার সমাধান করে বড়ো উপকার করলে। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।”
বিভাসদার মুখে এই সত্য ঘটনাটা শুনে ওকে করজোড়ে নমস্কার করে বললাম ,”সত্যিই তুমি এ সব মামলায় বস।”
বিভাসদা তখনই একজনকে ফোন করে বললো, “উকিল সাহেব গুড মর্নিং, আমি বিভাস। আপনার কাছে পাওয়া পরামর্শ অনুযায়ী আমি একজনকে ডিভোর্স থেকে বাঁচালাম। আপনি গ্ৰেট,ভালো থাকবেন।”
এরপর বিভাসদা আমায় বললো, “ডিভোর্স আটকানোর এই কৌশলমূলক শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম এই উকিলের কাছে। এক বছর আগে দীঘা গিয়েছিলাম। আমি এবং আমার বন্ধুরা যে হোটেলে ছিলাম ,ঐ উকিল সাহেব সেই হোটেলের এক রুমে ছিলেন। দীঘা থেকে ফিরে আসার দিন সকালে উনার সাথে পরিচয় হয়। উনিই আমাকে বলেন যে এক দম্পতি ডিভোর্সের জন্য উনার কাছে এসেছিলেন। ওদের উনি বুঝিয়ে দীঘা নিয়ে আসেন এবং একরাতের জন্য দুজনকে এক রুমে রাত কাটানোর জন্য অনুরোধ জানান। যদিও উক্ত দম্পতি তাদের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। কিন্তু দীঘায় এক রাত কাটিয়ে সকালে উনারাই উকিল সাহেবকে বলেন যে তাঁরা ডিভোর্স চান না। এখন থেকে একসাথেই থাকবেন। আজকের দিনে এমন সমাজসেবী উকিল পাওয়া বড়ই দুষ্প্রাপ্য!”
আমি বিস্মিত চোখে বিভাসদার দিকে তাকিয়ে বললাম ,”তুমিও কোন অংশে কম সমাজসেবী নও।”
আমি হাসতে হাসতে বলললাম,”আমার বা আমার পরিচিত কারও এ ধরনের সমস্যা হলে তোমার শরণাপন্ন হবো।”